বাসস্টপেজ থেকে চারপাশে তাকালে
ছাব্বিশটা গাছ দেখা যায় - আমি গুনেছি।
সাড়ে ছটার বাসটা প্রতিদিন চার মিনিট লেট করে,
একদম ঘড়ি ধরে, এদিক-ওদিক হয়না।
এত সূক্ষ্ণ ভুল কিভাবে করে - জানা নেই
জিজ্ঞাসা করার সাহস হয়নি,
পাছে আবার বলে বসে - “তুমিও তো করেছো,
অনেক বার ভুল,
অনেক বড় ভুল - বারবার, বারবার।”
আমি লজ্জায় পড়তে চাই না - তাই চুপ থাকি।
দেবদারু, ঝাঊ, বার্চ, পাইন, আরো কি কি
কেউ কিশোর, কেউ বয়স্ক - সতেজ বা নির্জীব
কেউ আরেকটা ঝড়ের অপেক্ষায়,
দাঁড়িয়ে থেকে ক্লান্ত হয়ে, এখন অজুহাত খোঁজে ।
মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে গাছ হই।
পাতার মুকুটে পাখির বাসা
বুকের কোটরে কাঠবিড়ালির সারাজীবনের সঞ্চয়।
বাসে ওঠার তাড়া নেই, কোথাও যাওয়ার নেই,
মনের বদলে আছে শক্ত কাঠ, কারো পালঙ্কের নকশা।
সাড়ে ছটার বাসের হর্ণে সম্বিৎ ফিরে আসে - আমার আর
গাছ হওয়া হয় না।
তাই আমি ভোররাতের বাসস্টপেজে হাঁ করে গাছ গুনি।
কবিতা
মাঝে মধ্যে কবিতা লেখার চেষ্টা করি, আশেপাশে বা নিজের দিকে তাকিয়ে।
সাল
নাম
-
২০২৫
-
গাছ
ম্যানচেস্টার ২০২৫
-
বোকা চাঁদ
ম্যানচেস্টার ২০২৫
আজ হঠাৎ মনে পড়লো তোমাকে।
ফেলে আসা মানুষদের নিয়ে লেখা কবিতার সূচীতে
যোগ হলো আরো কিছু শব্দবিন্যাস।
খুব তীব্রভাবে যে মনে পড়েছে, তা নয়
কিন্তু মনে পড়েছে অবশ্যই।
হঠাৎ করেই ঝড়ের পূর্ববর্তী বাতাসে
পেলাম তোমার চুলের ঘ্রাণ,
তেল আর কন্ডিশনার মেশানো - কিছুটা মিষ্টি;
ইচ্ছে হলো হাত দিয়ে ছুঁই, অপ্রাসঙ্গিক প্রয়োজন।
ঠোঁটের পুরু চামড়া, যা পুড়িয়েছি সিগারেটের আনন্দে,
তার উপরে স্পর্শ করলো তোমার নরম গাল।
কি অদ্ভূত, কি বিষণ্ণ;
মানুষ নেই, তার স্পর্শ জমা হয়ে আছে অযাচিত স্মৃতিতে,
ইচ্ছে হলো আরেকবার জড়িয়ে ধরি, নির্মম বিষাদ এলো।
আজ তোমাকে মনে পড়লো,
বোকা চাঁদ যেমন পিছু ছাড়ে না, তার মতই নাছোড়বান্দা,
এ মনে পড়া। -
মোটা চাল
ম্যানচেস্টার ২০২৫
প্রেম ছাড়া কি কবিতা হয় কি না
তা নিয়ে গোলটেবিল বৈঠক বসবে বসবে করছে -
বা বসেছে, ভাঙা রাস্তার মোড়ে।
প্রশ্ন গুরুতর - প্রেমিক এবং কবির সম্মতি আছে;
আলোচনা হওয়া প্রয়োজন।
জিলা স্কুল আর গার্লস স্কুলের ঠিক মাঝ বরাবর যে ক্যাফেটা -
তার মালিক,
পার্কের বাদামওয়ালা,
বৃষ্টিতে হুড উঠিয়ে চলা রিকশাওয়ালা, এবং
ব্যাচেলর বাসার দারোয়ান;
সবাই জড়ো হয়েছেন, নিজস্ব মতামত দিচ্ছেন।
প্রেম আর কবিতা সমভাবে অশ্লীল, নাকি সুন্দর,
তা নিয়ে এক পশলা কথা কাটাকাটি হলো।
তথাকথিত দর্শনের ছাত্র আবার দেখাতে চাইলো
প্রেম মানেই কবিতা, তারা সমার্থক এবং অনন্য।
ক্ষুধার্ত প্রজন্মের কবি গোর খুড়ে মুখ বের করে বললেন,
বিপ্লব, শালার বিপ্লব।
আমি এদিকে বসে আছি ট্রাফিকে, যাচ্ছেতাই গরম।
রাস্তা বন্ধ করে এসব অনুভূতি-টনুভুতি মারাচ্ছেন যে বড়,
এদিকে আমার স্টান্ড-আপের লেট হচ্ছে,
কেপিআইতে ভাটা পড়ছে,
জামার কলারে জমা হচ্ছে ঘামের দূর্গন্ধ।
কল্পনার স্বর্গ থেকে বাস্তবের মর্ত্যে নেমে আসুন কবি,
চোখের জল মুছে কিবোর্ডে হাত দিন, জনাব প্রেমিক।
প্রেমকে ছাড়া কবিতা, বা কবিতা ছাড়া প্রেম হয় কি না,
তার থেকেও অনিবার্য প্রশ্ন,
আজকে বাজারে মোটা চালের কেজি কত করে?
-
-
২০২৪
-
অস্থিরতা
ম্যানচেস্টার ২০২৪
কেমন যেনো একটা অস্থিরতা
বলে বা লিখে বোঝানো সম্ভব না।
পরীক্ষার আগের রাতে ঘুমোতে যাবার সময়ের মত -
যত দুঃশ্চিন্তা, ভয়, কিছুটা নিজের উপরে রাগ
গত এক সপ্তাহ ফাকিঁ দিলাম কেনো?
যেনো সাতদিনেই মিলে যেতো
বছর বছর ধরে জমা হওয়া ভূল হিসাব, অবহেলা, অযত্ন।
কাজের ব্যস্ততার পরেও কোথাও বিধে থাকা এই অস্থিরতা
পাশ কাটানো যায় না।
কি করছি, কেনো করছি, কার জন্য করছি
যার জন্য করছি সে কি জানে, কিংবা মানে?
শোনে কি সে? জলের শব্দ, নির্বিকার বয়ে চলা স্রোত।
মনের মধ্যে - যাতে ভেসে যায় আমার বর্তমান
অতীতের স্মৃতি, ঘুরে দাঁড়ানোর ইচ্ছে।
কেনো এইসব অচ্ছুৎ প্রশ্নের বাড়াবাড়ি,
কেনো কাঙালের মত শুকনো মাটিতে খুটিয়ে খুটিয়ে
খোজা দু-একটা শস্যদানা, যদি বাঁচে প্রাণ।
আমার আর ভালো লাগেনা, সমঝদার হতে হতে আমি ক্লান্তপ্রায় এখন।
এই যৌক্তিক জগতে ছায়া খুজে পেলেও, তাতে
দুঃদন্ড বসার উপায় নেই - আগুনের হল্কার মত বাতাস।
একটু নির্জীব হয়ে ঘুমোতে চাই আমি।
স্বপ্নে দেখতে চাইনা জ্বলজ্বলে নিশাচর চোখ
জাগরুক আলেয়ায় দেখতে চাইনা দ্বিধা, সন্দেহ
যত্তসব হিসাব-নিকাশ।
কেউ পাশে বসে হাতটা ধরুক, নিজের হাতটা ছুইয়ে দিক -
আমার অস্থির কপালে।
বিশ্বাস করে হাটুক দু-পা আমার সাথে।
এটা কি অস্থিরতা আসলেই - নাকি অন্যকিছু?
হবে হয়তো, আর ভাবতে ইচ্ছে করে না। -
আদ্রিতা
ম্যানচেস্টার ২০২৪
হৃদয়ে এক অদ্ভূত আদ্রিতা অনুভব করছি।
আমার ভালো লাগে অন্ধকার, রাত্রি,
কালো চুল, কালো চোখ, কালো ধোঁয়া,
ঝোড়ো হাওয়া, ভোরের কুয়াশা, দুপুরের গরম হল্কা,
ঝড়া পাতা, লেপের উষ্ণতা, গাঢ় নীল আকাশ,
পেজাঁ তুলোর মত মেঘ, সবুজ মাঠ - জানালা
দিয়ে মাঝরাতে আসা স্ট্রিটল্যাম্পের আলো।
সুরাপাত্র, বা সুরা নিজেই, তারপর পেট-ভরে ভাত।
জীবনানন্দ, শক্তি, তারাপদ, হেলাল হাফিজ,
এদের কবিতা, সত্যজিৎ রায়ের কাঠমুন্ডু বা বেনারস,
পরীর দিঘি, মাঝি পাড়া,
কিংবা আশির দশকের কলকাতা।
দুরছাই, আর কিছু মনে পড়ছে না, শুধু ভাবছি,
আমার ভালো লাগে তোমাকে। -
ইচ্ছে
ম্যানচেস্টার ২০২৪
ইচ্ছে প্রকাশ করি, ব্যাপারগুলো একটু সহজ হত।
যে আগুনে পা পুড়েছে, তার দাগ মিলিয়ে যেতো।
আমরা ঠিক যেন শীতে নদীর বুকে জেগে ওঠা চর,
সকালের শিশির, কিংবা রাতের জোয়ার
সবই আমাদের ডোবায়; বিচ্ছিন্ন বা সামগ্রিকভাবে।
কোথায় যেনো একটা ডাহুক ডাকছে -
জারুলের ডালে কি?
কেউ কি কাদঁছে, বা ভালোবাসছে?
তাই যদি হবে তাহলে হাহাকার বৃথা, ব্যর্থ অভ্যাস।
যে লেখা লিখে কেটে ফেলি কলমের এক টানে
যে প্রাণ শত আঘাতেও জানে -
সে ভালোবাসে; বাসতে চায় -
সইতে চায় একজন্মরুপ দীর্ঘশ্বাস। -
কাঁটা
ম্যানচেস্টার ২০২৪
এভাবে কি হয়?
ভাঙা মাটির বাসন টুকরো করে
জলে মিশিয়ে, কারিগরি করে,
আগের মত আবার বানানো যায়?
তোমাকে চিনি অনেকদিন।
ভাবলে মনে হয় এক যুগ, তারো বেশি
যতদিন থেকে নদী বয়ে চলেছে
এই রুক্ষ প্রান্তরের বুক চিরে - তার তীর ধরে
সরু পথে হাটছি আমি।
সাবধানে পা ফেলে আগাই
যেনো না মাড়াই ফুল, পতঙ্গ,
তোমার মন।
ভালোবাসি বলতে গিয়ে গলায় যে কাটাঁ বাধে
তা বিধে আছে আজন্ম, ঠিক ততদিনও নয়।
এভাবেও কি হয়? -
ক্যালেন্ডার
ম্যানচেস্টার ২০২৪
লিখতে বসলে আজকাল হাত কাঁপে।
মনে হয় যেনো প্রেমপত্র লিখছি,
কোচিং থেকে ফেরার পথে মেয়েটাকে দিতে হবে।
মনে হয় যেনো প্রাণপণে সমীকরণ মেলাচ্ছি,
পরীক্ষার সময় আর আছে দশ মিনিট।
মনে হয় যেনো শেষবারের মত টাইপ করছি,
“এভাবে আর হয় না, আমরা আলাদা হয়ে যাই।“
আঙুলগুলো কথা শুনতে চায় না, বারবার
কলমের এক-টানে কেটে দেয় মনের খবর।
এক দমবন্ধ সময়ে আটকানো জীবন।
উদ্দ্যেশ্যহীন সকাল, ক্লান্ত দুপুর,
বিকেল হলেই টান পড়তে থাকে বুকের বা-পাশে
হাত এসে পড়ে সস্তা ভুলে থাকার ওষুধে।
একটু একটু করে বেঁচে থাকার সরঞ্জাম খুঁজি,
সবকিছু অসহ্য লাগে ঘুমোতে যাবার আগে।
আর দৌড়াতে ইচ্ছে করে না, মনে হয়
একটা গাছতলায় গিয়ে একটু শুই, একটু আকাশ দেখি।
পাতার ফাঁকে ফাঁকে আলো, শীতের আগমনী বাতাস
ঝিঁঝিঁদের ডাক, একটু সময় নিয়ে শুনি।
পতিত মানবজমিন আবাদ করি, সোনার ফসল
উঠলে উঠতেও তো পারে ঘরে।
উপায় নেই, কর্কশ স্বরে ক্যালেন্ডার জানান দিয়েছে
কালকে এক হাজার কাজ, না করলে জাত যাবে। -
ঘুম
ম্যানচেস্টার ২০২৪
রাতগুলো এখন দীর্ঘতর।
শেষ বিকেলের ছায়ায় আমাদের জামরুল গাছটা
বট কিংবা অশ্বত্থ হওয়ার চেষ্টা করতো।
মাগরিবের আযানের শব্দে বুঝতাম
ঘরে ফেরার সময় হয়েছে -
তাড়াতাড়ি কল-পাড় হয়ে উঠোন পেরিয়ে আসতাম,
দরজা দিয়ে ঢুকেই ধূপের ঘ্রাণ।
আচ্ছা, হ্যারিকেনের আলো কি কিছুটা আচ্ছন্নকর?
ঘুমের সময়টা খুব পছন্দের ছিলো।
আবিদদের বারান্দার আলোটা জানালা দিয়ে,
কিংবা ঘুলঘুলি গলে,
আমাদের ছাদে খেলতে আসতো।
কি বিচিত্র সে-সব কারুকার্য, মনে হত -
এক নৌকায় শুয়ে আছি, সবসময় থাকবো।
আচ্ছা, তোমরা ঘুলঘুলি চেনো?
রাতগুলো এখন নিচ্ছিদ্র, আলো আসে না।
অনেকদিন আমি ঘুমাই না। -
জমি
ম্যানচেস্টার ২০২৪
মনের মধ্যে এক ফালি জমি বরাদ্দ
তোমার জন্য।
ছোট্ট একটু জায়গা, বিঘতখানেক হবে।
ঠিক ততটুকু, যাতে ধরে যায় তোমার আমার মন;
ঠিক ততটুকু, আমাদের হাসিগুলো
যেখানে প্রশান্ত নদীর মত বয়ে চলে।
একটু কম বা বেশি নয়, তোমার ঘ্রাণ আসে যে ফুল থেকে
তার চারাটা সেখানে জন্মাতে পারে
সেখানে তুমি আমি অমলিন স্মৃতির পাতা হাতড়াই।
ফাকা প্রান্তরের মত এই জমি,
অনিঃশেষ দুঃখের কবিতাসমগ্র শেষ হত
এই মাটিতে, এই জমিতে তোমার অধিষ্ঠান হলে। -
নদী আর আমি - ১
ম্যানচেস্টার ২০২৪
মাঝে মধ্যে আমি আর নদী আলাপ পারি
আমাদের দুঃখ, কি বিলাস নাকি প্রয়োজন।
একটা সময় সেটা মানুষ’কেন্দ্রিক ছিলো,
যখন কে আর কেন মূখ্য প্রশ্ন ছিলো -
কখন আর কিভাবে জানাটা জরুরি ছিলো,
তখন হয়তো বিলাস বলা যেতো।
এখন তা স্থান-কাল-পাত্রের উর্ধ্বে, আরো বিপন্ন।
মাথার উপরে কংক্রিটের ছাদ, আর তিনবেলা ভাত
তা স্বত্তেও নিজেদের দুঃখী ভাবাটাও একটা দুঃখ।
মাঝে মধ্যে আমাদের আলোচনা হয়
আমাদের কষ্ট কি পদ্মপাতার জলের মত নাকি।
যে বা যারা গেছে ছেড়ে, যেভাবেই যাক, গেছে অবশ্যই।
প্রথমবার রিকশায় ওঠা, হাত ধরা, নরম যত্ন-আত্তি
ঠোঁটে ঠোঁট রেখে জীবনের ব্যারিকেড উতরানো,
বা উতরাতে চাওয়া।
সেই কষ্ট কদ্দুর পুষে রাখা উচিত, আদৌও কি ঠিক?
নতুন জামা পেয়ে কি ভুলে যাওয়া যায় -
পুরোনা কাপড়ের মলিন কিন্তু পরিচিত ঘ্রাণ?
আমি আর নদী খুব তর্ক করি, বলি দূর্বল হোস নে।
ভান ধরি -
দাবানলের শেষ অঙ্গার পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকা বটের মত
স্থির, অনঢ়, আর শক্তিশালী আমরা।
ও বোঝে, চুপ করে যায়, জানে -
যে ছাই আমরা ঘাটতে চাই না
তার নিচে আসলে জ্বলতে থাকে অসহ্য অনল।
মানুষের ধিক্কার এবং উপহাস
”আর কতদিন এভাবে থাকবি?”, আর
”তোর একারই হয় নাকি, সবারই হয়েছে এমন” -
আমাদের আর ভাবায় না, ভাবাতে পারেও না।
প্রায়ই আমি আর নদী আলাপ পারি - যে
এই দুঃখই কি আমাদের অনুভূত শেষ প্রয়োজন কি না। -
নদী আর আমি - ২
ম্যানচেস্টার ২০২৪
আড়ম্বরহীন আলাপে সময় কাটে
কিভাবে আমরা আগলে রেখেছি আমাদের ক্ষত।
এতকিছু -
এতকিছুর পরও আকঁড়ে ধরে আছি হাসি-কান্না-দ্বিধা
পুরোনো বিকেল, শহুরে দালানের গা-চিড়ে
ছুটে আসা তীক্ষ্ণ আলো।
মনে পড়ে, সেই ঝোড়ো বাতাসের সন্ধ্যেবেলা
প্রহেলিকার মত কুয়াশা পড়েছিলো সেই শীতে।
মনে পড়ে, গুটিসুটি মেরে বসে আমরা দেখেছিলাম
পাহাড়ের চাঁদ, সমুদ্রের সূর্য, মাঠের শেষপ্রান্তে মেঘ।
মনে পড়ে, মনে কি পড়ে?
আমার স্নিগ্ধ নদী আমায় বলে, আসলে প্রশ্ন করে,
যা আমিও করেছি, করছি, করবো - নিজেকে
আবার? উত্তর স্বয়ংপ্রভ - না।
আমি চাইনা আর ভাঙতে যা কিছু অবশিস্ট
যা কিছু কল্যাণকর - আমার বা আমাদের মনে আছে।
আমাদের যা ভালো হবার ছিলো, তা সব তোমার হোক।
তাও কি হয়?
ভালো হওয়ার সংজ্ঞা-স্থাপন আমি জানি না। -
পনেরো মিনিট
ম্যানচেস্টার ২০২৪
প্রতিরাতে ঘুমানোর আগে পনেরো মিনিট
ভাবার জন্য খুব বেশি সময় না।
হন্য হয়ে উত্তর খোজা, পুরোনো ছবি উল্টেপাল্টে দেখা
কিছু লেখাজোখা।
একদম ঘড়ি ধরে পনেরো মিনিট
হুট করেই শেষ হয়ে যায় না।
সারাদিনে যা কিছু হলো, কি হলো
ভালো?
মন্দ হলেও বা কি?
কথায় কথায় বলা ফেলে দেওয়া কথা, সমঝোতা।
নয়শো বার শব্দ আসে ঘড়ি থেকে, এই পনেরো মিনিটে।
কিছুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, কিংবা
থেমে আছি।
আর কেইবা থামে, কেউকি জানে, এই
শব্দের মধ্যে কতবার কানে বাজে তার হাসি, কান্না
লোনা বাতাসে ভেজা খোলা চুল?
মাঝে মধ্যে মনে হয় কাটেনা এই কটা মিনিট।
পনেরো বছরের মত দূর্বিষহ,
পনেরো জন্মের মত ক্লান্ত।
অসহ্য, কাল আবার আসবে? -
পরজন্ম
ম্যানচেস্টার ২০২৪
দু’হাজার বছর তোমাকে দেখিনি।
দেখা হয়েছিলো কোনো এক প্রাচীন শহরে
ভিসুভিয়াসের বুক চিরে তখন বেরিয়ে আসছে কালো ছাই,
দ্বিখন্ডিত ধরণী মুক্তি দিতে চাইছে জমে থাকা আক্রোশ।
বুকে জড়িয়ে -
অচেনা ভাষায় বলেছিলে “ভালোবাসি”।
দু’শত বছর তোমাকে দেখিনি।
মড়ক লেগেছে তখন গ্রামে
অচেনা রোগ কেড়ে নিচ্ছে চেনা সংসার।
সিথিঁর সিঁদুর পায়ে ছুইয়ে দিয়ে বললে, আসি
তোমার চিতার কাঠ পোড়ালো আমার বলা, ‘ভালোবাসি’।
দু’বছর হয়ে গেলো, তোমাকে দেখিনি।
সেদিন পড়ে এসেছিলে আমার দেওয়া নীল চুড়িগুলো
সন্ধ্যাগামী বাতাসে তোমার চুল, আর ট্রাফিকের ক্যাকাফোনি,
জমে রইলো আমার শেষ স্মৃতি হয়ে।
মনে পড়ে, ফিসফিসিয়ে বলা, সেই ‘ভালোবাসি’?
দু’মিনিট আগেও তোমায় দেখেছি।
শব্দতরঙ্গে চেপে আটলান্টিকের বিদীর্ণ বুকের এপাশে
তোমার হাসি, কান্না, চিন্তা, সব ভেসে আসে।
শুধু একবার সাহস জুগিয়ে, চোখ বন্ধ করে,
বলা হয়নি, ‘ভালোবাসি’। -
বা-পাশ
ম্যানচেস্টার ২০২৪
কেমন যেনো একটা শিরশিরে অনুভূতি
বুকের বা-পাশে।
দূর্বল হৃদয় ভেবে ক্ষান্ত হই, আজন্ম অনভ্যাসের ফল
হয়তো শীত এসে গিয়েছে তাই।
আমার জানালা দিয়ে তাকালে
নিরস্ত্র, নাম না-জানা গাছটার ডালে
আর পাতা দেখা যায় না,
সকালে কুয়াশা ভাসে বদ্ধ রুমে ধোঁয়ার মত।
মৃত রাতের শুরুতে - আমি যখন কফিনে প্রবেশ করি,
প্রাত্যহিক মনের স্থানসংকুলান হয় না আর।
তখনো তুমি থাকো; এক কোণে; চুপটি করে
নিজের মত করে জায়গা করে নাও - ভাবাও আমাকে
পাশে কি কেউ থাকবে?
আমি আর উদ্দ্যেশ্য পাই না, প্রকাশ্যে
বা গোপনে স্বীয় আততায়ী হবার।
বুকের বা-পাশে শিরশিরানি, তোমার ভাবনা
আমায় শীতের বাতাসের মত ছুঁয়ে যায়। -
বাতাস
ম্যানচেস্টার ২০২৪
আমার জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকছে বাতাস।
আকাশ ভেঙে বৃষ্টি হয় যে রাতে
সেই রাতের ঠান্ডা বাতাস।
এই বাতাসে মিশে আছে ভেজা মাটির ঘ্রাণ
যে ঘ্রাণ আমি পেতাম আমার গ্রামের বাড়ির উঠোনে।
এই বাতাসে শোনা যায় পাতা ওড়ার শব্দ
যা আমি শুনেছিলাম শীতের কোনো এক বিকেলে।
এই বাতাসে ভেসে আসে বিন্দু বিন্দু জলকণা, কিংবা
চোখের জল।
যা ভিজিয়েছিলো আমার বুকপকেটে রাখা শুকনো গোলাপ।
বড় চেনা এই ঘুমকাতুরে বাতাস।
আজ আমি জড়িয়ে নেবো এই বাতাসকে।
আমার সমস্ত অনুভূতি জুড়ে থাক এই বাতাস।
হয়তো অনেক বছর পর, যখন
তোমাকে আর তুমি বলে চিনি না, যখন
আমরা সিংহল সমুদ্রের তীরে হেটে গেছি বহুদূর, যখন
তোমার আর ইচ্ছে করবে না হারাবার, যখন
প্রিয় নাম হারিয়ে যাবে নাম সংকলনের খাতায়।
এ বাতাস আমায় মনে করাবে কি হতে পারতো,
আর কি হলোনা। -
মানুষ
ম্যানচেস্টার ২০২৪
আজকাল মানুষ চিনতে পারি না।
কখনো পারতাম তাও মনে পড়ে না - কিন্তু
ইদানীং কথাটা বিশেষ্য।
ছায়া দেখে ভূল হয়; ভাবি প্রাণ আছে
তিমিরে প্রবঞ্চনাপ্রাপ্তি ঘটে।
মন্ত্রমুগ্ধ ব্যাধের মত, নীল চরণকে
ভাবি আর্ত হরিণী।
সন্দেহ জাগে, যার জন্ম হয়েছে বিশাখা নদীর তীরে
মনে পড়ে, নিকৃষ্টতর আগুন দাগ ফেলেছিলো শরীরে।
আমি তারে আমার মত চাইতে গিয়ে - ছুটেছি
একান্ত ভ্রমরের পিছু।
কে সে? কারে চাইতাম?
যারে চাইতাম সে দেখতে কেমন - ভাবি।
অন্যরুপে এলে, চিনবো কিনা, কিইবা হবে
স্ব অথবা দূরবর্তী স্থানে - মনের মাপে আটকাবে না।
বহমান বিশাখার মত মানুষ -
আর মানুষ নেই, ছায়া বলা যেতে পারে।
চিনতে গেলে মানচিত্র আর দাড়িপাল্লা নিয়ে বসতে হয়;
তাই মানুষ চেনার চেষ্টাও করি না আজকাল। -
মৃত্যু
ম্যানচেস্টার ২০২৪
বিভিন্ন রাতের মতো
আজ রাতেও মৃত্যু কামনা করছি।
অন্ধকার দেয়ালে বাইরের ছায়া দেখে দেখে আমি ক্লান্ত।
লাশকাটা ঘরে আমাকে নেয়া হোক আমি তা চাই না,
ঠান্ডা লোহার টেবিলকে আমার ভয় হয়।
আমি চাই না, বেচারা ডোম
অথবা থার্ড-ইয়ারের মেডিকেলের ছাত্রী,
আমার অন্তসারশূণ্য হৃদপিণ্ডটা দেখে -
মন ভেবে ভয় পাক।
আমি চাই না আমার জন্য জ্বলুক স্যাঁতস্যাঁতে প্রদীপ,
পনের টাকা প্যাকেটের শেষ আগরবাতি - খরচ হোক
সুগন্ধি টিস্যু, আমার চিন্তার গন্ধ ঢাকতে।
আমি চাই এমন এক ঝড়ের রাতে আমার মৃত্যু হোক।
অনেক বৃষ্টি হোক - বন্যার ডাক আসুক
আবহাওয়া অধিদপ্তরের কানে।
শশ্মানযাত্রীদের যাতে একটা সিগারেটও
আগলে জ্বালাতে হয় - আমার মড়া পাশে নিয়ে বসে।
আমি যাতে জানতে পারি, কে বা কারা, এই দূর্যোগে
আমায় শেষ দেখা দেখতে এসেছে।
আমার চিতার আগুন বারবার নিভে যাক -
অর্ধপোড়া লাশ ফেলে পালাক সবাই।
যে জীবনে আমি পূর্ণ হইনি, মৃত্যুতেও যেনো না হই।
প্রতিরাতের মত - আজও মৃত অনুভব করছি। -
মেয়েটা
ম্যানচেস্টার ২০২৪
আমি একটা মেয়েকে চিনতাম।
বেশ সহজ-সরল, মিষ্টি, আদুরে।
শীতের বিকেলে রিকশায় করে যখন ঘরে ফিরতো
নরম রোদ মুখে পড়লে খুশি হয়ে যেতো;
বৃষ্টি দেখলে হাত বাড়িয়ে দিতো জানালার ফাঁক দিয়ে।
আমি সেই মেয়েটাকে দেখতাম।
বন্ধুদের আড্ডায় তার হাসির ফোয়ারা ছুটতো; ঠিক
পাহাড়ী মুক্ত ঝর্ণার মত।
তারপর একদিন এক কাচের বাসন, খুব যত্নের
হাত থেকে পড়ে ভেঙে গেলো।
ইচ্ছা করে না, কেউ ইচ্ছা করে ভাঙেও না; কিন্তু
উপায়ও ছিলো না ওর ধরে ফেলার।
শত খন্ড হয়ে শক্ত আর ঠান্ডা নিষ্প্রাণ মেঝেতে
পেজা বরফের মত তা ছড়িয়ে পড়ল।
তারপর থেকে ও আর হাসেনি।
নির্বিকার নিরাসক্ত পৃথিবীর কাছে, সে হাসি
প্রার্থনাও করেনি।
“কেনো চলে গেলো দূরে?”র উত্তর খুজতে গিয়ে,
নিজেকেই হারালো নিজের থেকে।
যে মেয়েটাকে আমি দেখতাম ভালোবাসতে জানতো; চাইতো;
সে আর কখনো ভালোবাসেনি। -
সুপর্ণার সাথে কথোপকথন - ১
ম্যানচেস্টার ২০২৪
আমার খুব ভয় জানোতো সূপর্ণা, আমি
মানুষ বড় ভয় পাই।
মানুষের বাসার ছাদ থেকে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়।
উঁচু উঁচু খাঁচার মত বিল্ডিংগুলোর ফাঁকা দিয়ে
মাঝে মধ্যে সোনালী আকাশ, কালো দাড়ঁকাক,
নরম কুয়াশা, কিংবা মানুষের স্মৃতি দেখা যায়।
লুকিয়ে তুমি সেই ছাদে আসতে, মনে আছে সূপর্ণা?
খুব ভয়ে ভয়ে থাকতে কে আবার কাপড় শুকাতে আসে।
কখনো আসতে সিগারেটের ধোঁয়া ছড়াতে, কখনো
সিগারেটে পুড়ে কালো হওয়া ঠোঁটে ঠোঁট মেলাতে,
কখনো বা নিতান্তই দুঃদন্ড নীলের নিচে বসে থাকতে।
মানুষ বড় ভয়ের জিনিস।
মানো, সূপর্ণা?
আমি মাঝেমধ্যেই মানুষ স্বপ্নে দেখি, জেগেও দেখি
গলা শুকিয়ে আসে, হুট করে কাঁচা ঘুম ভেঙে যায়।
দেখি আমি বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছি।
মানুষের মধ্যে, আশেপাশে কালো কালো ছায়ার মত
মানুষের প্রেত -
আমার পাশেই, হাত বাড়িয়ে ধরতে গেলে নেই।
আমি তাও হাত বাড়াই, ইচ্ছা করেনা আর ভেসে বেড়াতে;
কিন্তু মানুষ কাছে আসে না।
আসতে চায় না। হয়তো পারেও না।
আমার আর ভালো লাগেনা, বুঝলে সূপর্ণা।
মানুষ মানুষ মানুষ খুজতে গিয়ে, আমি খালি ভয়ই পেলাম। -
সুপর্ণার সাথে কথোপকথন - ২
ম্যানচেস্টার ২০২৪
এই যে রাত জাগি, কেনো জানো সুপর্ণা?
কি ভাবছো, ঘুম আসে না বলে?
চিন্তার শাখাপ্রশাখা আক্ষেপ নামক জলের খোজে
মস্তিষ্কে শেকড় বসায়; বসায় আঘাত,
দীর্ঘপত্রপল্লবিত কিন্তু কোমল বাতাসে কেঁপে ওঠা -
নরম ডালের মত, খোঁজে রোদের তাপ আর
ভালোবাসার ঈষৎ উষ্ণতা?
আসলে তা না, বুঝলে।
রাত জাগি ঘুমোতে “চাই” না বলে।
বহুদিনের পুরোনো যে ক্ষতে বুলিয়েছি হাত
ঢেকে রাখি সযত্নে, সাদা কাপড়, তুলো
আর গজ দিয়ে চাপা দিতে চাই বিশুদ্ধ রক্তপাত।
লাল সেই জলতরঙ্গ প্রবাহ, চাই না
তোমার সাদা মনে দাগ কাটুক,
তোমার চোখের কোণায় অশ্রুবিন্দু আসুক।
আমি বড় হারা হেরেছি, জানো?
কবিতার কাব্যকার, তার আশেপাশের দেয়ালে
গড়ে তুলতে চাওয়া আমার সংসার।
গেছে যাক, হারলে ওরা হারাক - আমাদের কি?
আমি তবুও স্বপ্ন দেখে যাই।
তুমি, আমি -
জবুথবু শীতে এক চাদরে জানালার পাশে, কিংবা
অপূর্ব আকাশের নিচে এক রিকশার ছাউনিতে, কিংবা
ভয় পেয়ে গুটিয়ে থাকা পাহারায়, অন্তত
তোমার আমার নাতিশীতোষ্ণ হাতের স্পর্শে -
আর যেনো জেগে থাকতে না হয়। -
সূপর্ণার সাথে কথোপকথন - ৩
ম্যানচেস্টার ২০২৪
ক্ষেত্রবিশেষে আমি গভীর অবসাদ অনুভব করি
সূপর্ণা, তুমি কি তা জানো?
কিছু শব্দ, দৃশ্য, ঘটনা; উড়ন্ত এক স্থবির চিলের মত
বা মাঠপুকুরের পাশের রেললাইনের উপর দিয়ে ছুটে-
যাওয়া অনন্ত ট্রেন, আমাকে আঘাত করে।
যা আমি বহমান সময়ে দেখিনি, শুধু শুনেছি
শুধু বোঝার চেষ্টা করেছি মানুষের ক্রুরতা, পাশবিকতা,
তা আমার রক্তে ঢেলে দায় তীব্র-অসহ্য-অঙ্গার।
আমি চেষ্টা করি জানো, সূপর্ণা, মুখ ফিরিয়ে রাখতে।
জানি আমি জানি, যে অথবা যা, আমার তোমার
ক্ষমতার উৎস, লক্ষ্য, সংজ্ঞা -
তিনি নিরুত্তাপ।
লোকায়ত বিশ্বাসে আস্থা-স্থাপন করে, যদি
ধরে নেই পূর্বজন্মের স্মৃতি, তাও কি সওয়া যায়?
এই অক্ষমতা ক্ষমার অযোগ্য।
আমি প্রশ্ন করেছি, সকালের রোদের মত, কুয়াশা-
কিংবা বৃষ্টির ফোটাঁর মত, বাকি সব নয় কেনো?
আমি জেনেছি, জানতে বাধ্য হয়েছি
আমার গভীর বিষাদের কারণ মানুষ, সূপর্ণা। -
স্বপ্ন
ম্যানচেস্টার ২০২৪
মাঝে মধ্যে আমি স্বপ্ন দেখি।
মনে থাকে না বেশিরভাগই
কিছু আবার মন থেকে যেতে চায়না।
স্বপ্নে দেখি কলেজের বারান্দা, মাঠ, রোদ্দুর
বর্ষার রাতে ঠান্ডা বাতাসে ইউক্যালিপটাসের ঘ্রাণ
ক্লাস পালিয়ে তাজমহল রোড, জাপান গার্ডেনের ঘুপচি
কেমিস্ট্রি কোচিংয়ের সেই কাজলকালো চোখ।
তখন এত “স্ট্রাগল” ছিলো না
জীবন, জীবিকা, দায়িত্ব কিংবা রাতে কি রান্না হবে সেই নিয়ে চিন্তা।
মাঝে মধ্যে আমি স্বপ্ন দেখি।
তার মধ্যে কিছু কিছু বাকি দিন জেগে থাকতে দেয়না।
সেদিন যেমন দেখলাম সেই ভালোলাগাকে
যার সাথে হাটতাম হাতিরঝিলের পার ধরে
নগন্য আমার কখনো কিছু বলা হয়ে ওঠেনি।
লাল শাড়ি পড়ে আমার সাথে কোথায় যেন ঘুরতে যাচ্ছে
যে হাত কখনো আমার হাতে পড়েনি,
শক্ত করে তা আমার হাত দুটো জড়িয়ে আছে, স্বপ্নে।
স্বপ্নে অনেক কিছু আসে, যায়।
কিন্তু ইদানিং স্বপ্নভঙ্গ হলে শুধু হাহাকারটাই থেকে যায়
আর বিশেষ কিছু নয়। -
হত্যা, কবিতাকে
ম্যানচেস্টার ২০২৪
এখন কবিতার সময় নয়।
সময় এখন তীক্ষ্ণ-তীব্র গদ্যের।
মৃদু আলোর কবিতারা আজ পেছনে পড়ে থাক।
সমর্পণ বা নিবেদন যাকে তোমরা বলো -
কাব্যের হাত ধরে যা আসে মানুষের প্রতি, এ বিনতি
অর্বাচীন আজ, না হোক।
রুক্ষ শীতের শেষে ফাগুনের উষ্ণতা
পত্রপল্লবিত হয়ে যে রঙ আনে, তার মত না।
মা আসছে, বলে ঢাকের শব্দ
মনের এক কোণে যে শৈশবকে, সরলতাকে -
আনন্দকে প্রাণ দেয়, তার মত না।
ভালোবাসি ও বাসবো, এই নিদারুণ প্রতিশ্রুতির মত না।
কাব্যের এ কমনীয়তা দূর হোক; পুড়ে ছাই হোক।
পথ প্রশস্ত হোক দূর্বার উপন্যাসের, গল্পের, প্রবন্ধের।
যেখানে নেই কথার ছলনা, উপমা, অলংকার।
মরুর মত উন্নাসিক হোক সে, প্রাণদাত্রী জলের প্রতি।
দেওয়া-নেওয়ার হিসাব জানুক।
বাস্তবতার খড়গ হাতে সে শিরচ্ছেদ করুক কল্পনার -
স্বপ্নের, ভালোবাসার।
এই রুঢ়তাই আজ অধিষ্ঠান হোক কবিতার মানমন্দিরে।
কবিতা, তাই তোমার আজ মুক্তি।
-
-
২০২৩
-
ব্যস্ত
ঢাকা ২০২৩
তারে কইলাম,
কি য্যানি হইছে।
হাসফাস লাগে, দম ছাড়তে গেলে চোখে পানি আসে।
তারে কইলাম,
ফ্যানের সাথে ঝুলানো যে রশি,
আর বুকের সোজা বরাবর যে খারাপ লাগা,
তার ফারাক কয়েক ইঞ্চির কম মনে হয়।
সে জাগতিক কাজে ব্যস্ত।
দুইদন্ড অবসর নিয়া কইলো,
ঠিক হইয়া যাবে, ঘুমাও।
তাই সই।
ঘুমের মত মরার অনুভূতি আর কে দেয়। -
মন - ১
ঢাকা ২০২৩
মন নিয়ে কথা বলতে ভালো লাগেনা।
মন বলে কিছু নেই।
জীববিজ্ঞান তাই বলে।
মারদাঙ্গা পুরুষত্ব তাই বলে।
“হাসল কালচার” আর “কনস্যুমারিজম”; সুযোগে পেলে তারাও ছাড়ে না।
কিন্তু আমার মন ভালো হয়না।
যা নাই তা খারাপ হয়ে আছে -
সোজাসাপ্টা বলতে পারিনা কেনো খারাপ।
জীবনানন্দের লাশকাটা ঘরের
অর্থ নয়, বিত্ত নয়, এইসব বুঝে?
নারী হৃদয় বা অহৃদয়, ভালোবাসা বা অভালোবাসা,
চাপিয়ে দেয়া সার্বজনীনতা, অথবা সন্ধ্যের রঙ দেখে?
যেদিকে তাকাই আমি শুধু দুঃখ দেখি।
অন্ধ হতে পারিনা।
আমার মনও ভালো হয়না। -
মন - ২
ঢাকা ২০২৩
মানুষের নাকি মন আছে।
কবিদের স্বতঃসিদ্ধ স্বীকারোক্তি।
সেখানে নাকি জমা হয় সুখ, দুঃখ, কষ্ট
আনন্দ, ব্যাথা, বিষন্নতা, অভিমান, অবহেলা।
ভালোবাসা ও।
আমার তেমন মনে হয় না।
মন খুজতে গিয়ে আমি পাই হিসাব
দেয়া নেওয়ার কঠিন অংক,
চাওয়া পাওয়ার অসম্ভব দ্বৈরথ,
আমরা না হয়ে বরং আমি আর তুমি হওয়া।
দুর্বিষহ দুপুরের শেষে কালো মেঘের আগমনী বাতাস
বুকের মধ্যে যে শ্রান্তি আনে
আমার মনে হয় সেটাই মন
আর বিশেষ কিছু নয়।
-
-
২০২১
-
দেয়াল
ঢাকা ২০২১
তোমার দেয়ালে কতকিছু লিখি।
আকি।
শুনাই।
দেখাই।
দেয়ালের মালিক দেখে,
পৌরসভার লোকেরা দেখে,
পিচ করে পানের পিক ফেলতে গিয়ে
তোমার বাসার দারোয়ান দেখে।
সকালের মিষ্টি আর দুপুরের কুত্তামারা রোদ,
বৃষ্টির পচা পানিতে ডুবে যাওয়া রাস্তা,
পাশের বাসার গেস্ট বিড়াল,
কেউ বাদ যায়না দেখায়।
তুমিই খালি দেখলে না। -
যুদ্ধ
ঢাকা ২০২১
ভাবি যুদ্ধে নামবো।
তোমার আমার যুদ্ধ।
মহাভারতের মত অনিবার্য, প্রাচীন
নীতি আর বিশ্বাসের যুদ্ধ।
কথা আর প্রশ্নের অস্ত্রসস্ত্রসহ,
কেনো, কিভাবে, কখন নামের তীরগুলো;
না, না, আর না নামের তরবারিতে
ক্ষতবিক্ষত করবো, হবো।
কষ্ট থেকে আসবে স্বস্তি।
হয় না।
যুদ্ধের ময়দানে তুমি আসো শূণ্য হাতে,
হাসি আর কথার বৃষ্টি নিয়ে।
আমার অভিমানের সৈনিকেরা,
ইস্তফা দেয়।
আচ্ছা, তাহলে যুদ্ধ না হোক।
শান্তিচুক্তির দোহাই দিয়ে,
ভালোবাসি তাই, ভালোবেসে যাই।
-
-
২০২০
-
কবিতা
ঢাকা ২০২০
একটা বই খুঁজে বেরাচ্ছিলাম আমি, সবসময়
উপন্যাস না, ছোটগল্প না,
কঠিন সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রবন্ধ না।
একটা বই খুঁজে বেরাচ্ছি এখনো, একমনে।
ওল্ড ম্যান এন্ড দ্যা সি এর ওই বুড়োর গল্প না,
নন্দিত নরকের নরক না, কিংবা
মেঘনাদের বিশ্বাসঘাতক ভাইয়ের ইতিহাস না।
খুঁজছি।
একটা কবিতার বই খুঁজছি।
সারা বইজুড়ে একটাই কবিতা থাকবে,
একটা অলীক কবিতা, মুগ্ধ করে রাখার মত,
নিষ্প্রাণ মনে মৃতসঞ্জীবনীর মত,
একটু ভালোলাগার মত।
কত দরজায় কড়া নাড়লাম,
কত কবির পায়ের কাছে বসে থাকলাম,
লিখে দাওনা একটা?
বেশি কিছু না,
শুধু আধুনিক কবিতার মিলহীন অষ্টক।
এই ভূলে ভরা আত্মহত্যার প্রবঞ্চনা, আর
ছেড়া কিছু স্মৃতি ছাড়া; কিছুই দেওয়ার নেই তোমায়।
দয়া করো মৃত মানুষটাকে।
কবিরা হাসলো।
হাসলো তাদের বইয়ের প্রচ্ছদ, ঘুণে খাওয়া ভক্তকুল
সমবেদনা জানাতে আসা প্রকাশকও, অট্টহাসি থামাতে পারলেন না।
আর আমি?
আমি তপ্তরোদেগলা পিচ পায়ে নিয়ে,
একটা কবিতা খুজতে থাকলাম। -
জল
ঢাকা ২০২০
মাঝে মাঝে মনে হয় যদি জল হতাম?
আকার নেই, রং নেই
গন্ধ নেই, স্বাদ নেই
যে যেভাবে রাখে, ঠিক তেমন।
কারো গ্লাসে, কারো তুলিতে
কারো ভেজা চুলে, কারো অঞ্জলিতে
কারো তো হতাম।
হয়েছি বরফের টুকরো।
হাতে নিলে ছুড়ে ফেলে দিতে চাওয়ার মত নিষ্প্রাণ, অথবা
পড়ে গিয়ে শত টুকরো হওয়ার নিরাসক্তি।
জল হওয়ার উষ্ণতা কোথায় পাই? -
দ্বীপ
ঢাকা ২০২০
চুপ করে থাকি।
বোবা ঝড় উড়ালো শুকনো পাতা,
বৃষ্টির সিম্ফনিতে শোনা গেল কান্না
উটকো অনুভূতির ধ্বংসস্তূপ জমা হলো একা দ্বীপে।
কি যায় আসে তাতে?
পাথরচাপা হারিয়ে যাওয়া আমি ও আমিই ভালো। -
পারবে?
ঢাকা ২০২০
একটা কবিতা লিখে দাও।
কি লিখবে জানোনা বুঝি?
আমাকে নিয়েই নাহয় লেখো, আমার
গল্পের স্রোতে বিরক্ত হওয়া নিয়ে, অর্থহীন বোকামিগুলো নিয়ে,
না পাওয়ার তালিকায়, তোমার
নামটা যোগ করা নিয়ে?
একটা কবিতা লিখে দাও।
কি লিখবে জানোনা বুঝি?
শহর পুড়ছে, মানুষ মরছে, ময়লাখেকো কাকের
মন খারাপের উপহার বেচে, শিবরামের অট্টহাস্য নিয়ে।
জয় বাংলার জয়টা নিয়েও তো লিখতে পারো।
তাও যদি দুটো পয়সা আসে ঘরে।
আচ্ছা তোমাকে নিয়ে লিখতে পারবে?
মন-খারাপের স্তূপ কোথায় লুকালে
কিংবা তৃতীয় মুখোশের নিচের মানুষটা নিয়ে, পারবে?
জানি পারবে না।
বাচতে পারবে না।
মরতে পারবে না।
শুধু পারবে নিজের ছায়ামানব হয়ে থাকতে। -
বয়স
ঢাকা ২০২০
একদিন আমাদের বয়স হবে।
শেষ বিকেলের ছায়ার মত দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে আমাদের স্মৃতি,
নরম ভালোবাসায় আসবে জীর্ণতা।
হয়তো ভূলে যাবো কেমন ছিলো
তোমার হাসির শব্দ,
তোমার চুলের ঘ্রাণ,
তোমার ঠোটের উষ্ণতা।
একদিন আমাদের বয়স হবে।
প্রথম প্রেমে মরে যাবার গান শুনতে শুনতে,
প্রথম প্রেমকে না পেয়েই আমরা মরে যাবো।
-
-
২০১৯
-
চাওয়া
ঢাকা ২০১৯
বেশি কিছু চাইনি।
একটা হাসির বাক্স বা দু’সেকেন্ডের আগেই প্রতিউত্তর,
অপেক্ষাটা যাতে বোঝা যায়।
আচ্ছা, “ভালো আছো?” এর পিছনে যে উৎকন্ঠা,
এককাপ কফির নামে সময় অপচয়ের যে অজুহাত,
বোকা বোকা কথায় আরেকটুক্ষণ থাকতে চাওয়া,
খুব বেশি আবদার হয়ে যায়?
তুমি থাকো অট্টালিকায়, আমি বাবুইয়ের বাসা খুঁজি
ঝড় বৃষ্টিতে তোমাকে এই ছোট্ট ঘরে ধরে রাখতে চাইনা।
কিন্তু জেনে রেখো, বেশি কিছু না কিন্তু,
শুধু হাতটা নিয়ে মুখে ছুইয়ে দিলেই -
আর চাওয়াটা থাকে না । -
ডানা
ঢাকা ২০১৯
শরবিদ্ধ শহরে তীব্র আলোর ঝলকানি।
“শোনোওওওও; কার যেনো মন ভেঙেছে।“
প্রেমিক বেরোলো কালো চশমায়।
আলোটা খাতায় তুলে রাখতে, দৌড়ে এলো কবি।
মনভাঙাদের ঘরে আজ উৎসবের আমেজ, আরেকজন
প্রাণশূন্য অতিথি আসছেন।
সাইরেনের আওয়াজ ম্লান হলো কান্নার সুরে,
“এত প্রখর আলো দেখিনি তো আগে!”
সংবিগ্ন নাগরিকদের ফিসফিসানি মিলালো দূরে।
সবার কথা থাক।
ও ডানাভাঙা পাখি, উড়তে পারবে তো আবার?
তোমার ডানায় ভর করে যে দূরে পালানোর ইচ্ছে। -
দেখা
ঢাকা ২০১৯
চাহনিটা একফোঁটা খারাপ না বিশ্বাস করো,
না ফাটানো গোল্ডলিফের দিব্যি।
হয়তো বুকটা দুরুদুরু করে একটু
চোখে চোখ পড়ে গেলো যে?
এইযে এখন শুরু হবে,
রেডিওহেডের লিরিকটা বাজবে পরেরবার চোখ মেলানো পর্যন্ত।
আচ্ছা তুমি কি জানো আমি আছি?
ব্যস্ত ক্যাফেটেরিয়া, লিফটের লম্বা লাইন
টঙয়ের দোকানে তোমার জলপ্রপাতের মত হাসি,
সবই কেনো যেন চোখে আটকে যায়।
আচ্ছা আমার কালো রোদচশমার আড়ালের তীব্র ভালোলাগাটা,
কখনো তোমার চোখে আটকায় না? -
বিপ্লব
ঢাকা ২০১৯
মানুষ মরছে পথে-ঘাটে,
দিনশেষে ঘরে ফেরার তাগিদে হয়ে উঠছে বিশ্বজিৎ।
পড়ার টেবিল থেকে আবরার,
মায়ের কোল থেকে ঝুলন্ত লাশ,
“ঈশ্বর নেই” ব্লাস্ফেমির দায়ে -
একাডেমীর সামনে অসহায় রক্তাত দেহ ।
মায়েরা যাচ্ছেন আরেক মায়ের কাছে
৪০ পদের বুফে আর কাগজে লেখা কিছু সংখ্যা নিয়ে, ফিরে আসতে হচ্ছে ।
বিচার নিয়েছে চিলে, মেট্রোরেলের কলে,
বছর বছর পরেও, সাগর-রুনির মামলা চলে।
সহমত ভাই সহমত ভাই, ছাত্রলীগে সন্ত্রাস নাই।
রাস্তায় রাস্তায় আগুন জ্বলছে, মনে ক্ষোভ
আচ্ছা বিপ্লব কত দেরী?
বাঁচবো তো ততদিন? -
মুক্তি
ঢাকা ২০১৯
মাথার ভিতর শব্দজট।
হ্যা, কিরে, এইতো;
অথবা ভালো আছেন বলে হাত মেলানো
”হুম”, “আচ্ছা” আর বিরক্তি।
“কথা বলতে ইচ্ছা করে না, এত অসামাজিক ও”
একজন একজন করে বললো সবাই।
“শুকিয়ে গিয়েছে, নেশাটেশা করে বোধহয়”
একে ওকে ডেকে জানাই।
বন্ধ ঘরে বাঞ্চা করি,
কল্প তরুর সন্ধানে।
কারো বর্ষায় আসে, কারো শীত অবগাহনে।
শব্দ থেকে মুক্তি পেলি, মুক্তি পেলি বিচার থেকে
গল্প থেকে, আড্ডা থেকে, পচা সমাজের গন্ধ থেকে
অথবা সারারাত জাগার পর,
ভোরের আলোর মায়া থেকে।
মন্দ কিরে, মুক্তি তো পেলি? -
স্মৃতি
ঢাকা ২০১৯
আমার একটা ছবি ছিলো ওর সাথে।
বাউন্ডুলে বাতাসে ধোয়া ছড়াচ্ছি, ছায়াটা খালি ফ্রেমে আটকানো;
পুরোনো কাপড়ের মত হারিয়েছি।
অনেকদিন কথা হয়নি,
ওইযে হয় না? চোখের আড়াল মনের আড়াল কিসব যেনো,
হয়তো মনেই রাখেনি শেষপর্যন্ত।
আচ্ছা ও নেই কদ্দিন হলো?
কেউ কিছু বলছে না কেনো?
আমি নাহয় ক্ষণিকের,
কিন্তু বাকিরা তো ওর সাথেরই।
কারো কি হুট করে মুখটা ভেসে ওঠেনি একবারো?
জানি।
ফাঁকা ছবির অ্যালবামে, র্যাগডের শার্টে, কলেজের গলিতে,
এখনো টুকরোগুলো পড়ে আছে।
কুড়িয়ে পাওয়া যাবে না সব,
ও তো আর নেই, বাকিসব মিথ্যা অবয়ব।
-